আফগানিস্তানফেরত ফখরুল হাল ধরেন হুজির

স্টাফ রিপোর্টার:
মো. ফখরুল ইসলাম (৫৮)। ১৯৮৮ সালে আফগান যুদ্ধে যান। সেখানে আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর ভারত হয়ে তিনি দেশে আসেন। নব্বই দশকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি) এর সঙ্গে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর জামিনে মুক্ত হয়ে ছিলেন পলাতক। ফের হুজির হাল ধরেন তিনি। তার দলে বিড়িয়েছে আরও সদস্য। ঘরে বসেই বোমা তৈরি করে দেশে বড় হামলার পরিকল্পনা করেছিল তার নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া হুজি।

শনিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামা এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান।

এর আগে গত শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ফখরুল ইসলামসহ ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, মো. ফখরুল ইসলাম (৫৮), মো. সাইফুল ইসলাম (২৪), মো। সুরুজ্জামান (৪৫), হাফেজ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন (২৩), মো. দীন ইসলাম (২৫) এবং মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪৬)।

গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত নয়টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।

আসাদুজ্জামান জানান, হুজির মুফতি হান্নানসহ একাধিক নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ায় হরকাতুল জিহাদ সংগঠনটি নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই ফখরুল ইসলাম হুজির সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ সংগ্রহ করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।

কে এই ফখরুল ইসলাম-
আফগানিস্তান থেকে জঙ্গি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হুজি নেতা মো. ফখরুল ইসলাম ১৯৮৮ সালে গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানাধীন তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় তিনি দারোয়ানের চাকরি করতেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে কাজের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের করাচী যান। তিনি পাকিস্থানে অবস্থানকালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মুফতি জাকির হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। মুফতি জাকির হোসেন যিনি পাকিস্তানের করাচিতে ইসলামীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং আল কায়েদার সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

মুফতি জাকির আল কায়েদা সংগঠনের জিহাদী ট্রেনিংয়ের কমান্ডার। মুফতি জাকির ফখরুল ইসলামকে জিহাদের দাওয়াত দিলে সে দাওয়াত গ্রহণ করেন। ফখরুল ইসলাম জিহাদী ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য মুফতি জাকিরের সঙ্গে একাধিকবার পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরে দীর্ঘকালীন প্রশিক্ষণে যায়।

আফগানিস্তানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় ফখরুল-
ফখরুল ওই ট্রেনিংয়ে বিভিন্ন অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র- একে-৪৭, এলএমজি ও রকেট লাঞ্চার পরিচালনা শিখেন। ট্রেনিংয়ের সময় কান্দাহারের সমশেদ পাহাড়ে তিনি নিয়মিত ফায়ারিং অনুশীলন করতেন। অনুশীলনের সময় ফখরুল ইসলাম একে-৪৭সহ সশস্ত্র অবস্থায় প্রশিক্ষণ এলাকায় ৪ ঘন্টা করে নিরাপত্তামূলক পাহারা ডিউটি করতেন।

ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ-
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ওই সময়ে ফখরুল আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। তিনি আফগানিস্তানে বিভিন্ন মেয়াদে জিহাদী ট্রেনিং করার পর আবার পাকিস্তানের করাচিতে ফিরে আসেন। করাচী থেকে ১৯৯৫ সালে ইরানের রাজধানী তেহরান যান এবং প্রায় ৩ বছর সেখানে থাকার পর করাচীতে ফিরে এসে তিনি পরবর্তীতে ইসলামাবাদ থেকে ভারতের ভিসা নিয়ে ১৯৯৮ সনে বাংলাদেশে চলে আসেন।

যেভাবে হুজিকে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন ফখরুল-
সিটিটিসির এই কর্মকর্তা বলেন, সিটিটিসির জঙ্গি কার্যক্রম বিরোধী অপারেশন চলমান থাকায় এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নানসহ একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ায় হরকাতুল জিহাদ সংগঠনটি নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে এসে ফখরুল ইসলাম জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।

বিভিন্ন এনক্রিপটেড আ্যপস ব্যবহারে যোগাযোগ-
ফখরুল সাংঠনিক কার্যক্রম স্বশরীরে ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যম ব্যবহার করে অব্যাহত রাখেন। তিনি অত্যাধুনিক সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে এনক্রিপটেড আ্যপস Bip ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য হুজি সদস্যদের সঙ্গে উগ্রবাদী ও আক্রমনাত্মক বিষয়ে আলোচনা করে ম্যাসেজ আদান প্রদান করেন এবং যে কোনো সময় বাংলাদেশের গুরুপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের জঙ্গি হামলা পরিচালনার বিষয়ে নিজেদের মধ্যে পরিকল্পনা করেন।

রোহিঙ্গাদের রিক্রুট ও পাহাড়ী এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করতে চেয়েছিল হুজি-
বাংলাদেশের হুজি সদস্যদের বান্দরবান পাহাড়ী এলাকায় প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেছিল গ্রেফতাররা। ফখরুল ও তার ছেলে গ্রেফতার আসামি মো. সাইফুল ইসলাম অন্যান্য হুজি সদস্যদের নিয়ে একাধিকবার কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের তাদের সংগঠনে রিক্রুটের উদ্দেশ্যে এবং জিহাদী কার্যক্রমের অংশ হিসাবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রানিত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে বিভিন্ন মোটা অংকের টাকা অনুদান প্রদান করেন।

গ্রেফতার অপর আসামি হাফেজ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সিকিউরড এনক্রিপটেড আ্যপস ব্যবহার করে টেলিগ্রাম গ্রুপ ’মোরা সত্যের সৈনিক’র এডমিন “অস্থায়ী মুসাফির” হিসাবে ছদ্মনাম ধারণ করে গ্রুপটি পরিচালনা করে।

আসাদুজ্জামান আরও বলেন, মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন আ্যপসে নিজেকে মামুনুল হিসেবে ছদ্মনাম ধারণ করেন। হাফেজ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন টেলিগ্রাম আ্যপসের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য হুজি সদস্যদের সঙ্গে উগ্রবাদী ও আক্রমনাত্মক বিষয়ে আলোচনা করে ম্যাসেজ আদান প্রদান করেন।

যেভাবে দেওয়া হতো বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ-
নিষিদ্ধ ঘোষিত হুজির একটি এনক্রিপটেড আ্যপের প্রাইভেট চ্যানেল ’একটু প্রস্তুতির’ কনটেন্ট হিসেবে ’একটি বোমা তৈরি করো তোমার মায়ের রান্নার ঘরে শীর্ষক ১০ পাতার ডকুমেন্ট এবং একই চ্যানেল থেকে টাইম বোমা বানানো বাংলা বিবরনীসহ ভিডিও শেয়ার করে। আব্দুল্লাহ আল মামুন ওই এনক্রিপটেড আ্যপ্সের চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত কনটেন্ট তার সংগঠনের পরিচিত দুই একজনকে হাতে কলমে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ লাভের উদ্দেশ্যে এবং বোমা বানানোর নির্দেশনা দিয়ে শেয়ার করেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দাওয়াতী তৎপরতা
পুনরায় হুজি সংগঠনের পর রোহীঙ্গা ক্যাম্পে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়েছে চক্রটি। সেখান থেকে রোহীঙ্গাদের তাদের দলে নিতে তারা কাজ করেছেন বলেও জানান সিটিটিসি।

সিএনএস ডটকম//এসএল//