স্বামীর পরকীয়ায় গৃহবধূর আত্মহত্যা, আলোচনায় সেই মডেল রুপা

নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা

সামাজিক মাধ্যমে পরিচয় থেকে প্রেম। পরে পারিবারিক ভাবে বিয়ে। চারবছরের সংসারে আসে দুইসন্তানও। তবে জান্নাতুল ফেরদৌস নামের গৃহবধূর পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক। স্বামী ফিরোজ আলম মোশরাকিন পরকীয়ায় জড়ান এক মডেলের সঙ্গে। স্বামীকে অনৈতিক সম্পর্ক থেকে না পারার জেরে আত্মহত্যা করেন জান্নাতুল।

২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বরে ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায় জান্নাতুলের। এই ঘটনায় পালক মা জিরিনা খাতুন মেয়ে জামাই মোশরাকিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন উত্তরা পশ্চিম থানায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হওয়া মামলা এখনও ঝুলে আছে। বিচারের আশায় ডিএমপি কমিশনারের কাছে আবেদনও করেছেন জিরিনা খাতুন। মামলাটি ডিবি পুলিশ দিয়ে তদেন্তর আবেদন রেখেছেন তিনি।

মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে রিজিয়া খাতুন বলেন, ‘মোশরাকিন বর্তমানে জামিনে বেরিয়ে পরকীয়া প্রেমিকা রুপার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানতে পেরেছি তারা বিয়ে করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করলে আমার মেয়ের মৃত্যু রহস্য বের করতে পারবে।’ বলেন, ‘আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’

রিজিয়া খাতুন বলেন, ‘প্রথম দিকে আমি ওর (মোশরাকিন) সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু মেয়ে তাকে ভালোবাসে তাই বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। স্বর্ণালঙ্কার, দামি জিনিসপত্র সব ট্রাক ভরে দিয়েছি। কিন্তু এরপরও আমার মেয়েকে সে বাঁচতে দিল না।’

এদিকে থানা পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের মায়ের করা মামলায় ফিরোজ আলম মোশরাকিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। পরে কিছুদিন কারাগারে থাকার পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন আছে।

মামলা এজাহারে যা আছে:

মামলার নথি ঘেটে জানা গেছে, জান্নাতুল ফেরদৌসের বয়স যখন আড়াই বছর তখন পালক হিসাবে দত্তক নেন রিজিয়া খাতুন দম্পতি। জান্নাতুল আইউবিএটিতে (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যাণ্ড টেকনোলজি) পড়া অবস্থায় ফেসবুকের মাধ্যমে ফিরোজ আলম মোশরাকিনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়। ২০১৮ সালে পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে হয়। তাদের পরিবারে এক কন্যা এবং ছেলে সন্তান হলেও বিয়ের পর থেকে মোশরাকিন জান্নাতুলকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। পরে জানা যায় রুপা নামে এক মডেলের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে মোশরাকিনের। এ বিষয়ে পারিবারিক ভাবে কয়েকবার বসে সমাধান করা হয়।

মোশরাকিন ব্যবসা করবে বলে পাঁচলাখ টাকা দাবি করে জান্নাতুলের সঙ্গে প্রায় খারাপ ব্যবহার করত। রিজিয়া মামলার এজাহারে বলেছেন, মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে মোশরাকিনকে সেই টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার বন্ধ হয়নি; পাশাপাশি তার পরকীয়া সম্পর্ক অব্যাহত রাখে।

বিষয়টি মডেল রুপা ও তার মা রেহানাকে অবহিত করা হয়। কিন্তু তারা সে বিষয়ে সমাধান না করে আমার মেয়েকে ডিভোর্স দিতে বলে। এরমধ্যে আমার মেয়ে তার স্বামীর মোবাইলে রুপা ও মোশরাকিনের কক্সবাজারের ভ্রমনের বিমান টিকিট, বেশ কিছু ছবি-ভিডিও দেখতে পায়। এছাড়া তাদের মধ্যে অনেক অনৈতিক কথাবার্তা দেখে মানুষিকভাবে ভেঙে পড়ে। এরমধ্যে মোশরাকিন আমার মেয়েকে আত্মহত্যার করতে প্ররোচনা দিতে থাকে। গেল ১৩ ডিসেম্বর রাতে তাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া ও কথা কাটাকাটির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে মোশরাকিন আমার মেয়েকে বলে তার জীবন থেকে সরে যেতে এবং সকালে যেন তার চেহারা না দেখতে পায়। পরেরদিন সকালে পরিবারকে এসব কথা জানায়। তখন জান্নাতুল বলেছিল- তাকে মারপিট করা হয়েছে এবং দুই সন্তানকে বাঁচাতে বলে ফোন কেটে দেয়। স্বামীর এমন আচরণের পর ওইদিন ফ্যানের সঙ্গে ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে থানা পুলিশ। পরে পরিবারকে জানানো হয়।

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, পরকীয়া ও স্বামীর নির্যাতনের কারণে অতিষ্ঠ ছিল জান্নাতুল। হয় তাকে হত্যা করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অথবা হত্যায় প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে।

মডেলের একাধিক সম্পর্ক:

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে রুপার সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। এই তালিকায় সিলেটে কর্মরত কাস্টমসের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা, গাজীপুরের একজন কাউন্সিলর এবং চট্টগ্রামের একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তবে রুপাকে চেনেন না বলে সরাসরি জানিয়ে দেন কাস্টমস কর্মকর্তা। বলেন, ‘আমি এই নামে কাউকে চিনি না।’ এদিকে কাউন্সিলর দাবি করেন- তার সঙ্গে রুপার বাবার আগে থেকে সম্পর্ক। সেই হিসেবে তিনি চেনেন। এছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক নেয়। বলেন, ‘আমি চাই এই মামলা দ্রুত এগুক এবং অপরাধীর বিচার হোক। যতটুকু শুনেছি যেই মেয়ের কারণে জান্নাতুলের মৃত্যু হয়েছে, সেই মেয়ের সঙ্গে মোশরাকিন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ আর চট্টগ্রামের ওই কর্মকর্তা বলেন, আমি রুপার সঙ্গে বেশকিছু দিন যোগযোগ করেছিলাম। পরে জানতে পারি তার সঙ্গে অনেকে …. সম্পর্ক। এরপর আর যোগযোগ বন্ধ করে দিয়েছি।’

এসব বিষয়ে জানতে রুপার মা রেহেনা বেগমকে ফোন করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনে ফোন কেটে দেন। তবে তার বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়ে আপনার সাথে কথা বলব।’ পরে তিনি আর ফোন করেননি।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘এবিষয়ে আমরা অবহিত আছি। মামলার তদন্ত চলছে। সিনিয়র স্যাররাও খোঁজ-খবর রাখছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে মোশরাকিন বলেন, ‘আমি ভুল করেছিলাম পরকীয়া করে। তবে কারাগার থেকে বের হয়ে ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছি। আমার স্ত্রী যেকোনো বিষয়ে হঠাৎ রেগে যেতেন। যেদিন সে আত্মহত্যা করল বলা হচ্ছে আগের রাতে আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল কিন্তু আসলে এমন কিছু হয়নি। সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমানিল্য তো হয়, তবে সে আত্মহত্যা করবে না বুঝিনি।’ মডেলের সঙ্গে এখন আপনার সম্পর্ক অটুট রয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সব মিথ্যা কথা। আমি দুই সন্তান আর ব্যবসা নিয়ে আছি।’

//এস//