নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আসন্ন। প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ, নানা কসরত চলছে। প্রচারণা ঢাকা ছাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। জেলা-উপজেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন প্রার্থীদের পক্ষের কর্মীরা, চাইছেন ভোট। কখনো বাড়ি যেতে না পারলে ফোনে কুশল বিনিময় করেই চাইছেন সমর্থন। ফলে ডাকসু নিয়ে যতটা উত্তেজনা ঢাবি ক্যাম্পাসে, ততটাই উত্তেজনা তৃণমূল ও প্রান্তিক পর্যায়েও।
এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে সক্রিয় হয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। তারা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন করে ভোট চাইছেন এবং বিভিন্ন সুবিধা-প্রলোভনের আশ্বাস দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রচারণার পাশাপাশি চাপ প্রয়োগ ও হুমকি-ধামকির অভিযোগও উঠেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ অভিযোগ করে বলেন, আমাদের নারী প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে হুমকি দিয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতারা। তাদের বলা হয়েছে— তোমার মেয়ে কেন ছাত্রদলের বিরুদ্ধে কথা বলে? এসব করতে থাকলে তার সরকারি চাকরি হবে না।
শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নারী শিক্ষার্থীরাও একই ধরনের ফোন পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
ফেসবুকে এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী সাবরিনা জাহান। তিনি কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন বা দলের নাম উল্লেখ করেননি।
তিনি পোস্টে বলেন, ‘ভোট হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর যখন-তখন কল দিয়ে ভোট চায় জেলাভিত্তিক রাজনৈতিক কমিটির নেতারা। হোয়াট ইজ দিস ননসেন্স, ভাই? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব লোক আমাদের ব্যক্তিগত নম্বর পায় কীভাবে?…এখানে আমার প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে, আমি আমার ব্যক্তিগত নম্বরে কল দিতে যাকে-তাকে অ্যালাও করব না, তা–ও কল দিয়ে আবার আমার সব ডিটেইল (বিস্তারিত) বলে তারা। এ জন্য হলেও আপনারা অনেক শিক্ষার্থীর বিরক্তির কারণ হওয়ায় ভোট হারাবেন। সুস্থ রাজনীতি করার অনুরোধ রইলো।’
সাবরিনার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অভিযোগ করেছেন, আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে তাঁদের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে ভোট চাইছেন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ বেশি আসছে ছাত্রদল ও বিএনপির বিরুদ্ধে। ছাত্রদলের এক প্রার্থী শিক্ষার্থীদের এভাবে ফোন না দিতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের প্রতি অনুরোধও জানিয়েছেন।
আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক সামিয়া আক্তার রোকেয়া হল সংসদে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আজ সন্ধ্যায় তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছুক্ষণ আগে আমার ফোনে একটি কল আসে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতির পক্ষ থেকে। আমাকে বলা হলো, যেন ৯ তারিখ ছাত্রদলের প্যানেলে ভোট দিই। এখানে আমার মূল প্রশ্ন হলো—আমি আমার ভোট নিজেই দেব এবং যাকে খুশি তাকে ভোট দেব। একজন জেলা পর্যায়ের বিএনপি সভাপতি কি আমার ভোট ঠিক করে দেওয়ার অধিকার রাখেন? তাঁর কমান্ডে আমার ভোট দিতে হবে?’
তার ফোন নম্বর কীভাবে একজন জেলা নেতার কাছে পৌঁছাল, সেই প্রশ্ন তুলে এই ছাত্রী আরও লিখেছেন, ‘এটি শুধু প্রাইভেসির (ব্যক্তিগত গোপনীয়তা) লঙ্ঘন নয়, বরং নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও এক গুরুতর ঝুঁকি। বিশেষভাবে, নারীদের নম্বর এভাবে অন্য ব্যক্তিদের কাছে সরবরাহ করা তাঁদের নিরাপত্তা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় হুমকি।…আমার নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।…আমার মনে হচ্ছে, ভোটের স্বাধীনতা এবং নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা—দুটোই এখনই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ ব্যাপারে ছাত্রদলের দায়িত্বশীলদের অবস্থান জানতে চাচ্ছি।’
শামসুন নাহার হল সংসদে এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে প্রার্থী হওয়া নিয়ম মনি দুপুরে ফেসবুকে লেখেন, ‘আজ সকালে আমার ফোনে একটা কল আসে, স্থানীয় বিএনপির একজন নেতা আমাকে কল দেন এবং ছাত্রদলকে যেন ভোট দিই, তার জন্য প্রেশারাইজ করেন (চাপ প্রয়োগ করেন) এবং বলেন, আমাদের উপজেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ৯ তারিখের আগে দেখা করবেন, যেন ছাত্রদলের প্যানেলকেই আমরা ভোট দিই। প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী কাকে ভোট দেবে না দেবে এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আপনারা সর্বোচ্চ অনুরোধ করতে পারেন, কিন্তু ছাত্রদলের প্যানেলকেই ভোট দিতে হবে—এ সিদ্ধান্ত আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। এই এখতিয়ার কি আদৌ আপনার আছে?’
ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, খুলনার রূপসা উপজেলা ছাত্রলের সেক্রেটারি ইমতিয়াজ আলী সুজন চৈতী নামের এক শিক্ষার্থীর বাড়িতে গিয়ে ছাত্রদলের প্রার্থীদের জন্য ভোট চাইছেন। ভিডিওতে সুজনকে ছাত্রদলের আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদের জন্য ভোট চাইতে দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র মোশাররফ হোসেন, যার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। এলাকার স্থানীয় বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তার বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের কাছে অনুরোধ করেছেন যাতে ছাত্রদল মনোনীত আবিদুল ইসলাম খানকে তিনি ভোট দেন।
এ বিষয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি পজিটিভভাবে দেখছি। ডাকসু এখন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শহর থেকে গ্রাম সবার নজর ডাকসু নির্বাচনের দিকে। ৫ আগস্ট পরবর্তী এটাই প্রথম উৎসবমুখর পরিবেশ নির্বাচনের।
ঢাবি শিক্ষার্থী আরমান হোসেন বলেন, চাঁদপুর জেলা ছাত্রদলের পক্ষ থেকে মাগরিবের ঠিক আগ মুহূর্তে আমাকেও কল দিয়েছিল। ৪ মিনিটের ফোনালাপে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি— এভাবে কল দিলে ফলাফল হিতে বিপরীত হবে। অথচ সে উল্টো বলল— ভোট দিলে এলাকায় সুবিধা পাবেন।
ডাকসুর সামাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবি জুবায়ের বলেন, আমাকেও ফোন দিয়েছিল, আমার জেলা বরিশাল বিএনপির সেক্রেটারি। ছাত্রদলকে ভোট দিতে বলে। আমি ধমক-টমক দিয়ে রেখে দিয়েছি।
অভিযোগের বিষয়ে যা বলছে ছাত্রদল
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসুতে ছাত্রদল মনোনীত জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, সারা বাংলাদেশের আপামর জনতা এবং বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী যারা আমাকে কিংবা আমার প্যানেলকে সমর্থন করছেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ কোনো শিক্ষার্থীকে ফোন দিয়ে আমাদের জন্য ভোট চেয়ে প্লিজ তাদেরকে বিব্রত করবেন না। আমি আপনাদের আবেগ-অনুভূতি-সমর্থনের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে আপনাদের অনুৎসাহিত করছি। আমি জানি, এ দেশের আপামর জনতার দোআ-সমর্থন ও ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে রয়েছে। এ সময়ে আপনাদের দোয়া আমার ও আমাদের কাছে মুখ্য।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বলেন, প্রিয় ঢাবি শিক্ষার্থীবৃন্দ অনেকক্ষেত্রে বিরোধীরা নিজেরা ফোন করে আপনাকে বিব্রত করতে পারে। তাই তদন্তপূর্বক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন এই আশা আপনাদের কাছ থেকে আপনাদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি করতে চাই।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সারাদেশে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আমরা এটা সমর্থন করি না, বরং এর তীব্র বিরোধিতা করি। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সারাদেশে এক ধরনের আমেজ তৈরি হয়েছে। খুলনার ঘটনায় রূপসা ছাত্রদলের যিনি ভোট চেয়েছেন, তিনি তার ওই এলাকার পাড়া-প্রতিবেশী, তাই ব্যক্তিগতভাবে নিজ দায়িত্বে ফোন দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ফোন দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানোর যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত এবং এক ধরনের অপবাদ বলে আমরা মনে করি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদল থেকে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এভাবে ভোট চাওয়ার আমরা তীব্র বিরোধিতা করি। তবে ঘটনাকে অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরা ও বোঝানো কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
প্রসঙ্গত, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫ আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ৫০৯ জন প্রার্থীর মধ্যে সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৫ জন। সর্বশেষ প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে ৩৯ হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থীর। এবারের ডাকসু নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থাকবে ৮টি এবং বুথ সংখ্যা ৭১০।
Discussion about this post