বিশেষ প্রতিবেদন:
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা এলাকার বাসিন্দাদের কাছে মূর্তিমান আতংঙ্কের নাম ছিল দীপু আর অপু। মিজানুর রহমান চাকলাদার ওরফে দিপু চাকলাদার ছিলেন আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হাবিবুর রহমান ওরফে অপু চাকলাদার স্থানীয় থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক। সহোদর এই দুই ভায়ের তাণ্ডবে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতেন এলাকার সাধারণ মানুষ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চাকলাদার ওরফে দিপু চাকলাদার। আর ৫ আগষ্টের পর নতুন করে আবারো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে মানি লন্ডারিং মামলায় গত ৭ জানুয়ারি জামিন নামঞ্জুর করে হাবিবুর রহমান ওরফে অপু চাকলাদারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন মেজিষ্ট্রেট আদালত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকার মুদি দোকানদারের দুই ছেলে মিজানুর রহমান চাকলাদার ওরফে দিপু চাকলাদার (৪৯) ও হাবিবুর রহমান ওরফে অপু চাকলাদার (৫৪) ।
আওয়ামী সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাকি দিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মানিলন্ডারিং এর অন্তত ২২ টি মামলা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা হলেও টাকার জোরে তারা বহাল তবিয়তে ছিল।
২০১৭-২০১৮ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সাবেক দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৬৬১ বার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ’ লগ ইন করে অবৈধভাবে মালামাল খালাস করা হয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ওই সময়ের তদন্তে উঠে আসে।
শুল্ক ফাঁকি ও চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান চাকলাদারকে আসামি করে ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার রমনা থানায় একটি মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
পরে তাদের দুই ভাই ছাড়াও কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় আরও ২২ টি মামলা করা হয়।
মামলার পরপরই কাকরাইল থেকে এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান চাকলাদারকে আটক করে পুলিশে দিয়েছিল সংস্থাটি।
অন্যদিকে, ১০৫ কোটি ৯ লাখ ৯৩ হাজার ৭০ টাকা আত্মসাৎ ও সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামীলীগের মাফিয়া খ্যাত দীপু চাকলাদার এখন অত্মগোপনে থাকায় অপু চাকলাদার ভাইয়ের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিএনপি দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে অপু চাকলাদার।
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান দিপু চাকলাদার আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় মুন্সীগঞ্জে তার অপরাধ চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতা বড় ভাই হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার। মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানা বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এসেছে।
জানা গেছে, হাইব্রিড এই নেতা বিএনপির সদস্য সচিব অপু চাকলাদার নামে পরিচিত। চাদাঁবাজি এবং দখল বাণিজ্যসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা এলাকায় একেবারে ভিন্ন চিত্র।
গণঅভ্যুত্থানের আগে অপু চাকলাদারের আপন ভাই মাফিয়া খ্যাত মিজানুর রহমান দিপু চাকলাদার আওয়ামীলীগ সরকারের পুরো সময় জুড়ে এলাকায় চাদাঁবাজিসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। চাঁদাবাজি, সুদ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও জমি দখলবাজিসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যে দীপু চাকলাদার করেননি। ক্ষমতার দাপটে অপকর্মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। অবৈধ উপায়ে আয়ের অংশ টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে দীপু চাকলাদারের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর লৌহজং-এ দীপু চাকলাদারের পারিবারিক রাজত্ব কমে নি। শুধুমাত্র হাত বদল হয়ে সব ক্ষমতার দম্ভে পরিনত হয়েছে দিপুর ভাই অপু চাকলাদার। আওয়ামী দুঃশাসন আমলে নিয়ন্ত্রণ করতেন মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার। এখন ভাইয়ের সকল অপরাধের সাম্রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি নেতা অপু চাকলাদার। দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে স্থানীয় তালতলা ডহুরি খালে নির্ধারিত চাদাঁর বিনিময়ে চলছে অবৈধ বাল্ক হেড। দখলবাজদের অতিতের সব আমলনামা জেনেও নীরবতা পালন করছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিগত সময়ে মিজানুর রহমান দীপু যে সব লোকের মাধ্যমে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন এখন ওই লোকগুলোই পেছনে থেকে বিএনপি পন্থীদের সামনে এনেছে । আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মিলে মিশেই গড়ে তুলেছে হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার সিন্ডিকেট।
স্থানীয় বিএনপির নেতারা জানায়, দখলবাজি ও চাদাঁবাজিতে অপু চাকলদারের সংশ্লিষ্টতা সামনে আসায় স্থানীয় বিএনপি’র ত্যাগী নেতাকর্মিদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিএনপি নেতা জানান,লৌহজংয়ে চলছে একটি বিশেষ পরিবারের রাজত্ব। এরা নিজেদের স্বার্থে আওয়ামীলীগ আমলের সব মাফিয়াদের রক্ষা করে চলেছে।কারণ আওয়ামীলীগের সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠা আওয়ামীলীগ নেতা রশিদ সিকদার, আশরাফ চেয়ারম্যান, সেলিম মোড়লসহ অধিকাংশ নেতারাই অপু চাকলাদারের পারিবারিক আত্নীয় ও পরমবন্ধু। এ সকল আওয়ামীলীগ মাফিয়াদের ব্যবসাসহ অবৈধ সকল কাজকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করছে এখন বিএনপি নেতা অপু চাকলাদার। বিএনপির হাই কমান্ড থেকে বার বার দখল, চাদাঁবাজিসহ কোন প্রকার সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির মতো কাজে নেতাকর্মিদের জড়িত না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও সেদিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই অপু চাকলাদারের। এতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিএনপির জনপ্রিয়তা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের কারণে গত ২ বছর বাল্কহেড চলাচল বন্ধ ছিলো। এ কারণে খালের পাড়ও ভাঙেনি। এ বছর আবার বাল্কহেড চলাচল শুরু হওয়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এভাবে বাল্কহেড চলতে থাকলে পদ্মার ভাঙনে খালের দু’পাশের জনপদও বিলীন হয়ে যাবে । আতঙ্ক বিরাজ করছে ডহুরি খালের দু’তীর জুড়ে বাসিন্দাদের মধ্যে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধূ লৌহজং নয়, রাজধানীর ইসলামপুরে রয়েছে মিজানুর রহমান দীপু পরিবারের বিশাল সিন্ডিকেট। ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে কাপড় আমদানী করে খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সরকারের শত শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরা বনে গেছেন ধনকুবের। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর এখন সে সাম্রাজ্য রক্ষার নেতৃত্বে সামনে চলে এসেছেন দিপু চাকলাদারের ভাই বিএনপির অপু চাকলাদার। এই অনৈতিক এবং অবৈধ কাজে তিনি থানা বিএনপির সদস্য সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি ব্যবহার করছেন। এতে বিএনপির ভাবমূর্তি দারুন ভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
সরকারের শত শত কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে হাবিবুর রহমান দিপু চাকলাদার ও মিজানুর রহমান অপু চাকলাদার- মুদি ব্যবসায়ী ছেলে থেকে বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ দেশের বাহিরে পাচার করেছেন কয়েকশো কোটি টাকা।
সরজমিনে ঘুরে তাদের কয়েকশো কোটি টাকার ফ্ল্যাট, মার্কেট ও আলিশান বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।
মিজানুর রহমান অপু চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান দিপু চাকলাদারের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার ডহুরী গ্রামে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার আগে তাদের একটি টিনশেড ঘর ছিল। এখন সেখানে সেই টিনশেড ঘরটি থাকলেও পাশে তৈরি করেছেন আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনে করেছেন ফুলের সুন্দর বাগান।ওয়ারীর অভিজাত এলাকায় ওয়ারি কমপ্লেক্সে ২২০০ স্কয়ার ফিটের তৃতীয় তলার দুইটি প্রায় চার কোটি টাকার ফ্ল্যাট। মামলায় এই বাসার ঠিকানা দেওয়া হলে তারা ফ্ল্যাট দুটিকে ভাড়া দিয়ে চলে যান ওয়ারী ৩ নং নবাব স্ট্রিটের শুভেচ্ছা ভিলার নয় তলায়। সেখানে ২২০০ স্কয়ার ফিটের দুটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট রয়েছে যার প্রায় মূল্য ৫ কোটি টাকা।
কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকায় চাকলাদার টাওয়ার নামে দশতলা একটি মার্কেট ও পাশেই গ্রীন টাওয়ার নামে দশ তলা আরো একটি মার্কেট রয়েছে। সদরঘাটের শরীফ মার্কেটের পাশে ১৪ তলার একটি হক মার্কেট রয়েছে । ইসলামপুরে ৩০ টি মার্কেটে শেয়ার রয়েছে তাদের দুই ভাইয়ের। পুরান ঢাকার গুলশানারা সিটির অষ্টম তলায় সাত থেকে আট হাজার স্কয়ার ফিটের একটি আলিশান অফিস রয়েছে হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদারের এবং চায়না মার্কেটের পঞ্চম তলায় ১৬ হাজার স্কয়ার ফিটের আলিশান অফিস রয়েছে মিজানুর রহমান দিপু চাকলাদারের। বিদেশে পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা।এসব অফিসে বসেই দুই ভাই তাদের এসব অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান দিপু চাকলাদের মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দিলেও তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। আর অপু চাকলাদার মানি লন্ডারিং মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
Discussion about this post