বিনোদন ডেস্ক
ঢালিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনি অভিনয়ের ভাবনা নিয়ে কখনোই কলকাতায় পা রাখেননি। দেবরাজ সিংয়ের ‘ফেলু বক্সী’ ছবিতে তার চরিত্র সম্পর্কে জানার পর তিনি ‘না’ বলতে পারেননি, তাই এ ছবিতে কাজ করা। ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। কলকাতায় প্রথম পরীমনি অভিনীত বাংলা ছবি ‘ফেলু বক্সী’ আগামীকাল ১৭ জানুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে । তার বিপরীতে আছেন অভিনেতা-বিধায়ক সোহম চক্রবর্তী।
‘ফেলু বক্সী’ ছবিতে তার প্রথম কাজ। ভিসা সমস্যায় শহরে ছবির প্রচারে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু মুঠোফোন কি কাঁটাতারের বিভেদ মানে? এ ছবি মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি হন ঢালিউড অভিনেত্রী পরীমনি। আর এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক উপালি মুখোপাধ্যায়। এটি যুগান্তর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
প্রশ্ন: টালিউডে পরীমনিকে স্বাগত…
পরীমনি: (ফোনের ও পারে), কী সুন্দর বললেন! মনটা ভালো হয়ে গেল। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রত্যেককে চিনি, আপনজন মনে হয়।
প্রশ্ন: ‘ফেলু বক্সী’তে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে এ রকমই খুশি হয়েছিলেন?
পরীমনি: সত্যি বলতে কী, অভিনয় করার ভাবনা নিয়ে কলকাতায় আসিনি। মনে মনে কোনো প্রস্তুতি না থাকলে সেটি হলে বা না হলে কোনো অনুভূতি তৈরি হয় না। আমারও তাই। কারণ তখনো আমি পুরোপুরি মাতৃত্বে ডুবে। পদ্ম আরও ছোট। ওকে সামলে কী করে কাজ করব— সেটিই একমাত্র চিন্তা। ওকে ছেড়ে কাজ করার ভাবনাও নেই। কিন্তু ছবিতে আমার অভিনীত চরিত্র শোনার পর সেই আমি কিছুতেই ‘না’ বলতে পারলাম না। একটাই অনুরোধ— এক্ষুনি চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। বললে ছবি দেখার আনন্দই মাটি (হাসি)।
প্রশ্ন: টালিউডে অভিনয় মানেই অধিকাংশের স্বপ্ন— দেব বা জিতের নায়িকা হওয়া। নয়তো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কাজ করা। তা হলো না বলে কি মন খারাপ?
পরীমনি: বিশ্বাস করুন, একটুও না! আমি রাজি হব, সেটাই তো ঠিক ছিল না। আমার কাছে যে কোনো কাজ সম্মানের ও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ একদিনে নাম করে ফেলেন না। তা ছাড়া কে বলতে পারে— আজ যিনি নতুন, তিনি তার প্রথম কাজেই বিখ্যাত হবেন না? নতুনদের প্রতি তাই সমান বিশ্বাসী ও শ্রদ্ধাশীল। দলের প্রত্যেকে প্রচণ্ড সুসংবদ্ধ। ভীষণ নিয়মনিষ্ঠ, যা দেখে মনে হবে না ওরা নতুন।
প্রশ্ন: কলকাতা যে আপনাকে নায়িকা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল…!
পরীমনি: তা হলে তো আপনি জানেন— আমায় কোন চরিত্রে দেখা যাবে (বলেই হা হা হাসি)। সাধারণত বাণিজ্যিক ছবিতে নায়িকা কেবল নায়কের সঙ্গে নাচগান না, প্রেম করে। আর দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া হয়। এই চেনা গণ্ডিতে সারাক্ষণ থাকতে ভালো লাগে? ‘ফেলু বক্সী’র গল্প শোনার পর মনে হলো— নায়িকা না হয়ে আমি যেটা বেছে নিয়েছি, সেটি করলে অভিনয়ের অনেক সুযোগ পাব। ওই চরিত্রেই আমায় বেশি মানাবে। আরও একটা ব্যাপার— মাতৃত্বের কারণে আমি তখন পৃথুলা। শিফন জড়িয়ে নাচের মতো ছিপছিপে নই। এ দিকটাও ভুলিনি। নায়িকা তো আমি আবারও হতে পারব। আরও একটা ব্যাপার আছে…
প্রশ্ন: সেটি কী?
পরীমনি: গতে বাঁধা কিছু নিয়ম থাকে ইন্ডাস্ট্রিতে। ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই দর্শকমনে নায়িকার আদল তৈরি করে দেয়। দর্শকও সেটিই বোঝেন। আমরা নিজেরাই যদি ছক না ভাঙি তা হলে আর কবে এগোব? দিন বদলেছে। এখন নায়িকার থেকেও ‘অভিনেত্রী’ শব্দটি বেশি পছন্দ সবার। পর্দায় কতক্ষণ দেখা গেল— এটা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না। কত বেশি দর্শকমনে থেকে যেতে পারলাম, সেটিই আসল কথা। একটা দৃশ্যে অভিনয় করেও কিন্তু আত্মতৃপ্তি বা সমালোচকের প্রশংসা পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আপনি ফেলুদা বা ব্যোমকেশ পড়েছেন? রহস্য কেমন লাগে?
পরীমনি: (মিষ্টি হেসে) ওমা! পড়িনি আবার। আমার রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প পড়তে, ছবি দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।
প্রশ্ন: এই ছবিতে নাকি পরীমনিই রহস্য ছড়িয়েছেন?
পরীমনি: দেখা যাক…, আপনি কিন্তু দুষ্টুমি করে চরিত্র জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন!
প্রশ্ন: নায়ক-প্রযোজক সোহম চক্রবর্তী সম্পর্কে পরে জানব। আগে সহ-অভিনেত্রী মধুমিতা চক্রবর্তী সম্পর্কে কিছু বলুন?
পরীমনি: আরে! ও তো আমাদের দেশে মধুমিতা কম, ‘পাখি’ বেশি। ধারাবাহিক ‘বোঝে না সে বোঝে না’র জন্য। ওর নামে আমাদের দেশে পোশাক তৈরি হয়েছিল। দেখি সবাই ‘পাখি ড্রেস’ পরছে। আমিও পরেছি। কী যে মিষ্টি মেয়ে, যেন সত্যিকারের ‘মধু’। খুবই সহযোগিতা করেছে। কাজের ফাঁকে আড্ডাও দিয়েছি। ও বাংলাদেশের ‘পাখি’, আমি ‘পরীমনি’। দুইয়ে মিলে মনে হয় ভালো কিছুই হবে।
প্রশ্ন: প্রযোজক-নায়ক সোহম চক্রবর্তী?
পরীমনি: খুব বেশি আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পাইনি। তখন একটাই চিন্তা, তাড়াতাড়ি শট দিয়ে পদ্মর কাছে যেতে হবে। সেটের প্রত্যেকে সেই বিষয়ে ওয়াকিফহাল ছিলেন। যে কারণে কেউ আমায় আটকাতেন না। এও জানি, এসব হয়েছে সোহম দার জন্যই। খুবই সহযোগী তিনি।
প্রশ্ন: সোহম পশ্চিমবাংলার শাসক দলের বিধায়ক, জানেন তো?
পরীমনি: আর বলবেন না— প্রথম দিনের দৃশ্যে অভিনয় করব। সোহম দার দেহরক্ষীরা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। গেটের সামনে, সিঁড়ির মুখে। আমরা শিল্পীরা তো এভাবে কাজ করে অভ্যস্ত নই। ফলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছিল। শেষে সুন্দর করে অনুরোধ জানালাম— সোহম দা, ওদের একটু সরে দাঁড়াতে বলবেন? একগাল হেসে সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ রাখলেন। সরিয়ে দিলেন দেহরক্ষীদের। একটু চিন্তা হয়েছিল, যদি সোহম দা ভুল বোঝেন। আসলে একজন শিল্পীকে শিল্পীর মতো করে পেতে চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: পরীমনি কি খুব দুষ্টু? না ছেলেমানুষ এখনো? পুরুষ বন্ধুর হাত নিয়ে খেলা করে সবার ঘুম ছুটিয়ে দেন…
পরীমনি: ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি যখন প্রথম নাচ করতাম তখনকার বন্ধু। এত ভালো নাচে যে ওকে ‘দীপিকা পাড়ুকোন’ বলে ডাকি। আসল নাম চঞ্চল। একদিন একসঙ্গে গাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে ফিরছিলাম। হঠাৎ মনে হলো এ রকম কিছু করলে কেমন হয়? তার যে এই ফলাফল হবে বুঝতে পারিনি।
প্রশ্ন: অনুরাগীরা ভাবলেন, আপনি আবার প্রেমে। সবাই শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিলেন…
পরীমনি: কী করে যে বোঝাই, আমার আর প্রেম আসে না। ওই জোন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সবার শুভেচ্ছা পড়তে পড়তে মনে হলো— বুঝি বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওর পুরো অংশ দিয়ে আত্মসমর্পণ করলাম। আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম…
প্রশ্ন: প্লিজ, বলুন।
পরীমনি: ওই যে বলে না— যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। আমার যেন সেই দশা। আমার প্রেম নিয়ে আমার যত না মাথাব্যথা, বাকিদের যেন বেশি! আরে আমার প্রেম, নতুন প্রেম— কোথায় আমি উত্তেজনায় ফুটব। জেগে স্বপ্ন দেখব। আনন্দে মেঘমুলকে ভাসব— তা না, তাদের দেখি কী উৎসাহ-উদ্দীপনা। আমার প্রেম হলে ওদের যে কী সমস্যা? দেখি মন-টন ভেঙে যায়। আমি কারও হব না— তাতে লোকে খুশি। একজন কারও হলেই বিশাল ব্যথা। আনন্দবাজার অনলাইনের মাধ্যমে সব ভক্ত-অনুরাগীদের জানাচ্ছি— আমি কারও নই বাবা, তোমরা খুশি থাক।
প্রশ্ন: পরীমনি আর নায়িকা নয়, অভিনেত্রী হতে চান। দুষ্টুমি করতে চান না। নতুন করে প্রেমে পড়তেও নারাজ! জীবন কি পরীকে বড় করে দিল?
পরীমনি: বড় না, জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। অনেক রকমভাবে চলতে শেখাল। সম্ভবত আমার এখন সেই অবস্থা যাচ্ছে। তা ছাড়া এত প্রেম করেছি, আমার মতো ফাটিয়ে প্রেম বোধহয় ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ করেনি, এক গাল হাসিতে আবার বললেন—আমার প্রেমের তাই কোটা শেষ।
প্রশ্ন: এটা পরীর বাইরের দিক, অন্তরে পরী কি খুব একা, ক্লান্ত?
পরীমনি: নিজেকে নিয়ে এভাবে কোনো দিন ভাবিইনি। হ্যাঁ, কখনো কখনো অবশ্যই ক্লান্ত লাগে। দিন দুই আগেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছি— আমি নামেই পরী, আমার তো পরীদের মতো জীবন নয়। আমিও বাকিদের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। আমারও মন খারাপ হয়, রাগ হয়, দুঃখ হয়। তবে এখন রাগ-অভিমান-মন খারাপের কোনো জায়গা জীবনে নেই। কার ওপর রাগ করব? এসব অনুভূতি সরে যাওয়ায় আমি সুখি। কারণ এই অনুভূতিগুলো মনের ওপরে ছাপ, চাপ— দুই-ই ফেলে। বিশেষ করে প্রেমে পড়লে। কারও ফোন ধরতে না পারলে বা আমার ফোন না ধরলে মন খারাপ (বলেই হাসি)। কী জ্বালা বলুন তো— এসব নেই বলেই ছেলেমেয়েদের সামলেও কাজে মন দিতে পারছি। আমার এটাই চ্যালেঞ্জ ছিল, একা হাতে সন্তান মানুষ করে পেশাজীবনেও উন্নতি করব। যাতে আমার দ্বিতীয় ইনিংস নিয়ে ওরা গর্ব করতে পারে। এই মনোযোগ যদি আরও আগে দেখাতাম, তা হলে আমার অবস্থান হয়তো আরও অন্য রকম হতো।
প্রশ্ন: ছেলেমেয়েদের নিয়ে কী ভাবছেন? মায়েদের তো অনেক স্বপ্ন…
পরীমনি: সবার আগে চাইব, যেন ভালো মানুষ হয়। তার পর ওরা যেটা হতে চাইবে, সেটাই হবে। পাশে থাকব। অভিনয় করতে চাইলে আপত্তি নেই। পদ্ম ফুটবল খেলতে ভালোবাসে। খেলোয়াড় হতে চাইলে সেটিও হতে পারে। ওদের ইচ্ছে আর আমার সমর্থন— ভালো কিছুই হবে, কী বলেন?
প্রশ্ন: যুগ আধুনিক হয়েছে, সমাজ নয়। ‘একা মা’-এর যাত্রা তাই এখনো কঠিন। নিজেকে কী বলে সাহস দেন?
পরীমনি: সত্যিই খুব কঠিন। আমি পারছি মানেই সেটা সহজ নয়। তারপরও পারছি। হাসিমুখে পারছি। খুশি মনে পারছি। দিনের শেষে এই ‘পারছি’টাই আমায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।
প্রশ্ন: কলকাতা আর বাংলাদেশের বিনোদন দুনিয়ায় কাজের মধ্যে অনেক ফারাক?
পরীমনি: কোনো ফারাক নেই। দুই দেশেই ভালো কাজ হয়। গল্প বুঝে কোনোটা তাড়াতাড়ি, কোনোটা সময় নিয়ে হয়। কিন্তু ভালো কাজ হয়। ভাষাও এক। কেবল যাতায়াতে যে সময়টুকু লাগে। বিমানে উঠলেই মনে হয়, এই তো পাশের ঘরে পৌঁছে গেলাম। কলকাতা আমার কাছে বিদেশ নয়। হ্যাঁ, শুরুতে একটু নতুন নতুন মনে হয়েছিল। ছবির শুটিংয়ের আগে বিজ্ঞাপনী ছবিতে কাজ করলাম। করতে করতে দেখলাম, সবাই খুব চেনা। কাজের ধারাও জানা।
প্রশ্ন: কলকাতায় বাড়ি কিনবেন পরী? ফুচকা, রসগোল্লা…
পরীমনি: (উমমমম) নেব নেব। একটা বাড়ি কিনব ভাবছি।
প্রশ্ন: আর কোন কোন পরিচালক ও নায়কের সঙ্গে কাজের ইচ্ছে?
পরীমনি: সেটাও তো ভেবে দেখিনি! দাঁড়ান, (সেকেন্ডে ভেবেই) আপনাদের বুম্বা দা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: বুম্বা দার সঙ্গে আপনার কাজের কথা হয়েছিল না?
পরীমনি: ওই জন্যই ওর নাম নিলাম। হ্যাঁ, একটা কাজের কথা হয়েছিল। আমি তো আনন্দে ফুটছি। হঠাৎ প্রযোজনা সংস্থার তরফ থেকে সমস্যা তৈরি হলো। ব্যস, আর হলো না।
প্রশ্ন: একটা প্রশ্ন করি— বাংলাদেশ আর কলকাতায় যেখানে আপনি সেখানেই পাশে অভিনেতা জয় চৌধুরী…?
পরীমনি: আরে আরে! কী যে বলেন। ও তো আমার বান্ধবীর বর। ওর বউ আমার বন্ধু, আমার বোন। জয় তাই ‘দুলাভাই’, আপনাদের ভাষায় জামাইবাবু।
প্রশ্ন: কলকাতা বলে, শ্যালিকা কিন্তু জামাইবাবুর ‘আধি ঘরওয়ালি’… খুব মিষ্টি সম্পর্ক
পরীমনি: সত্যিই আমাদের মধ্যে খুবই মিষ্টি সম্পর্ক। খুব মজা করি আমরা। এরপরই কণ্ঠে ছদ্ম শঙ্কা ফুটিয়ে বললেন— দোহাই, কলকাতায় আবার এই গুঞ্জনটা যেন ছড়িয়ে দেবেন না। সাংবাদিকদের বড় ভয়। ফের হাসিতে ফেটে পড়লেন পরীমনি। লজ্জায় লাল হতে হতেও কণ্ঠে তৃপ্তির হাসি।
সূত্র: আনন্দবাজার
Discussion about this post