নিজস্ব প্রতিবেদক
চাকরির প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজের জীবিত স্বামী আল আমিনকে (২২) মৃত দেখিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করানো হয়, এমন দাবি করেছেন মামলার বাদী কুলসুম বেগম।
শুক্রবার সকালে আশুলিয়া থানা হেফাজতে কুলসুম ওই দাবি করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার থেকে কুলসুমসহ তিনজনকে আটক করে নিয়ে আসে আশুলিয়া থানার পুলিশ।
গত ২৪ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বামী আল–আমিনকে হত্যার অভিযোগে ঢাকার একটি আদালতে মামলা করেন কুলসুম বেগম। পরে ১৩ নভেম্বর আল–আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে নিজের জীবিত থাকার বিষয়টি পুলিশকে জানালে তাকে সাভার থানায় আনা হয়। অন্যদিকে মামলা করে আদালতে হাজির হচ্ছিলেন না কুলসুম। পরে তার বিরুদ্ধে সমন জারি করেন আদালত। গতকাল তাকে আটক করে পুলিশ।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, মামলার বাদীসহ আরও দুজনকে কক্সবাজার থেকে আটক করে থানা হেফাজতে আনা হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য বাদীকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকি দুজনের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পুলিশি হেফাজতে থাকা কুলসুম (২১) মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার সিংজুরী এলাকার আব্দুল খালেকের মেয়ে। অন্য দুজন হলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর থানা এলাকার রুহুল আমিন (৬৪) ও শিবালয় থানার টেপড়া এলাকার শফিউদ্দিন (৪০)। রুহুল আমিন ও শফিউদ্দিনের ফাঁদে পড়ে কুলসুম মামলা করেন বলে তিনি দাবি করেন।
আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে মিথ্যা মামলার বাদী কুলসুম বেগম জানান, চার বছরের সন্তানকে নিয়ে স্বামী আল-আমীনের সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি সিলেটে থাকতেন তিনি। গত ২৮ আগস্ট দাম্পত্য কলহের জেরে সিলেট থেকে সাভারে বোনের কাছে চলে আসেন কুলসুম। আসার পথে গাড়িতে শফিউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তিনি চাকরির জন্য সাভারে আসেন বলে জানান।
কুলসুম বেগম দাবি করে বলেন, ‘এই সুযোগে শফিক আমাকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রুহুল আমীনের কাছে নিয়ে যান। পরে রুহুল আমীন ও শফিউদ্দিন আমার চাকরির জন্য জন্ম নিবন্ধন চেয়ে সাভারের সেনা শপিং কমপ্লেক্সে দেখা করেন। এসময় তারা জন্ম নিবন্ধন দিয়ে আমার স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা প্রস্তত করেছে বলে জানায়। এতে রাজি না হলে তারা নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে আদালতে নিয়ে উকিলের সামনে কাগজে স্বাক্ষর নেন। রুহুল আমীন ও শফিউদ্দিন ব্ল্যাকমেইল করে মামলা করতে বাধ্য করেছে এবং আমাকে কক্সবাজারে বাসা ভাড়া করে দিয়ে থাকতে বলে।’
বাদী কুলসুমের বোন ফাতেমা বলেন, ‘আমার বোনকে রুহুল আমীন নানাভাবে ভয় দেখিয়েছেন। তিনি মামলা, ফাঁসি এমনকি সবসময় রুহুলের কাছে পিস্তল থাকে বলে ভয়ভীতি দেখান। রুহুল আমীন বেশ কয়েকজনের নাম মামলা থেকে কেটে দিয়েছেন। সে সময় আমার ছোটবোনকে আদালতে নিয়ে যান তারা। তারা বলতো যে অজ্ঞাত ছেলেটা মারা গেছে সে যেন বিচার পায় সেজন্য এই মামলা দায়ের করেছেন। পরে বুঝতে পারি তারা একটি চক্র ও মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। আমার বোন আশুলিয়া কিংবা সাভারে থাকতো না। সে থাকতো সিলেটে। শফিউদ্দিন ও রুহুল আমার বোনকে ফাঁসিয়েছ।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শফিউদ্দিন বলেন, ‘কুলসুমের সঙ্গে আমার গাড়িতে পরিচয় হয়। পরে তাকে নিয়ে আমি রুহুল আমীনের কাছে যাই। তিনি মামলার সব কাজ করেছেন।’
অপর অভিযুক্ত রুহুল আমীন বলেন, ‘কুলসুমই আমার কাছে মামলা করার জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন। টাকার বিনিময়ে আসামির নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে রুহুল জানায় মনোয়ার মাস্টার, বাশার, ইলিয়াস শাহী ও সারোয়ার তালুকদারের নাম মামলা থেকে বাতিলের জন্য এভিডেভিড করা হয়েছে। তবে তাদের কাছে কোনো টাকা নেয়া হয়নি।’
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর বলেন, ‘জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলা দায়েরের ঘটনায় শফিউদ্দিন, রুহুল আমীন ও কুলসুমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা মিথ্যা মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আগামীকাল শনিবার মামলার বাদী কুলসুমকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য আদালতে পাঠানো হবে।’
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোড়া হলে অন্তত অর্ধশতাধিক লোক মারা যায়। তাদের মধ্যে বেওয়ারিশ হিসেবে একজনের মরদেহ দাফন করা হয়। সেই লাশটিকে নিজের স্বামী আল-আমিন দাবি করে ১৩০ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন কুলসুম বেগম।
Discussion about this post