স্বাস্থ্য ডেস্ক
২ বছর পেরিয়ে গেলেও করোনা মহামারীর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ববাসী। অর্থনীতিতে এর প্রভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে স্বাস্থ্যখাতেও। কমেছে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। বেড়েছে নানা শারীরিক জটিলতা। এরই মধ্যে নতুন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স (এমপক্স)। আফ্রিকা থেকে ছড়ানো এই ভাইরাস নিয়ে চিন্তায় আছেন বিশ্ববাসী। এমনকি গত ১৪ আগস্ট এই ভাইরাসের সতর্কতায় জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডব্লিওএইচও)। ২০২২ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো এই বাড়তি সতর্কতা জারি করল সংস্থাটি।
দ্য আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়। আফ্রিকার কঙ্গো থেকে শুরু হয়ে ভাইরাসটি বুরুন্ডি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান, কেনিয়া ও রুয়ান্ডাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি পৌঁছে গেছে ইউরোপের সুইডেন ও এশিয়ার পাকিস্তানেও।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতবছরের একই সময়ের তুলনায় এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্তের হার বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৯ শতাংশ। আর তাই ভাইরাসটির উচ্চ মৃত্যুহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অর্থোপক্স ভাইরাস। এই ভাইরাসের তালিকায় আরও রয়েছে গুটিবসন্ত ও কাউপক্স এর নাম। তাই মাঙ্কিপক্সের সাথে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সের মিল দেখা যায়। অন্যদিকে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের দুটি ক্লেড বা উপজাতি রয়েছে। ‘মধ্য আফ্রিকা ক্লেড’ মাঙ্কিপক্সে মৃত্যুহার ১০% পর্যন্ত হতে পারে। আর ‘পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেড’ মাঙ্কিপক্সে তেমন মৃত্যু হয়নি।
মাঙ্কিপক্সের শুরু কবে থেকে?
এটি একটি ভাইরাসজনিত প্রাণীজাত (জুনোটিক) রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি বিজ্ঞানাগারে একটি বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয়। এজন্য একে মাঙ্কিপক্স বলা হয়। তবে নামটি বদল করে নতুন বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ এই নামটির কারণে মনে হতে পারে কেবল বানরের কারণেই এই রোগ হয় যা সঠিক নয়। ইঁদুর, বন্য কুকুর, কাঠবিড়ালি, বানর ও খরগোশের শরীর থেকে এটি সংক্রমিত হয়। ১৯৭০ সাল থেকে প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে এ রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
মাঙ্কিপক্স কীভাবে ছড়ায়?
সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি যেকোনো ধরনের সংস্পর্শ বা যৌনমিলনের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এছাড়া রোগের ব্যবহার করা কাপড়, সুই বা অন্যান্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত প্রাণী শিকার করা, কাটা বা রান্না করার সময়, কম তাপমাত্রায় আক্রান্ত প্রাণীর রান্না করা মাংস খেলেও এই রোগ হতে পারে। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী (যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগী, মহিষ) থেকে এ রোগ ছড়ায় না। এমনকি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের থেকেও এই ভাইরাসটি তাদের অনাগত শিশুর কাছে পৌঁছাতে পারে।
মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ কী?
জীবাণু সংক্রমণের সাধারণত ৩ থেকে ১৭ দিনের মধ্যে এর লক্ষণগুলো শুরু হয় যা সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে এটি আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
মাঙ্কিপক্সের কিছু লক্ষণ হলো জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, গলাব্যথা, কাশি লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া এবং ত্বকে পানিভর্তি ফোসকা হওয়া। তবে অনেকক্ষেত্রে এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি উপসর্গবিহীন থাকতে পারেন।
আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসকুড়ি হয় হাত, পা, বুক, মুখ, লিঙ্গ, অণ্ডকোষ, ল্যাবিয়া, যোনি, মলদ্বারসহ যৌনাঙ্গের কাছাকাছি অংশে। ফুসকুড়িগুলো প্রাথমিকভাবে পানিভর্তি ফোসকার মতো দেখতে হয়। এসব ফোসকায় ব্যথা ও চুলকানি থাকে।
মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা কী?
মাঙ্কিপক্সের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সাধারণত উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা, পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পেলেই রোগী দ্রুত সুস্থ হতে ওঠেন। চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর, মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এছাড়া রোগের তীব্রতা বেশি হলে অ্যান্টিভাইরাল (টেকোভিরিম্যাট, সিডোফোবির) ওষুধ দেওয়া হয়।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেশনে রেখে ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত চিকিৎসা করার মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা কমানো সম্ভব। কোনো কোনো দেশে এবং যাদের ঝুঁকি বেশি থাকে তাদের গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এই টিকা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে।
মাঙ্কিপক্সের জটিলতা
রোগীর সঠিক চিকিৎসা না হলে শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত, বিকৃত দাগ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, কর্নিয়াল ইনফেকশন, অন্ধত্ব, সেপটিসেমিয়া, এনকেফালাইটিস মতো সমস্যা সঙ্গী হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের উপায়
আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকুন।
আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়ে মাস্ক পরুন।
সাবান পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধুয়ে নিন। (৩০ সেকেন্ড ধরে)
আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সাবান/ জীবাণুনাশক/ ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করুন।
আক্রান্ত জীবিত/মৃত বন্যপ্রাণী অথবা প্রাকৃতিক পোষক (যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ) থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
প্রাণীর মাংস সঠিক তাপমাত্রায় রান্না করে খেতে হবে।
মাঙ্কিপক্সের কোনো লক্ষণ দেখামাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাংলাদেশে এখনও এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে এসম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।
Discussion about this post