নিজস্ব প্রতিবেদক
মাগুরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদন থেকে শুরু করে ছবি তোলা, ফিঙ্গার দেয়া কিংবা পাসপোর্ট বিতরন- সব কিছুই চলে একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাগুরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস যেখানে দালাল ছাড়া কোন কথাই বলা যায় না।
তারা অভিযোগে আরো বলেন, এই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাসপোর্ট সেবা পাওয়া যায়, এর বাইরে কোন সেবা গ্রহীতা পাসপোর্ট সেবা নিতে আসলে পড়তে হয় নানারকম হয়রানিতে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব অনিয়মের মূলহোতা সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কামাল হোসেন সরকার। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই কর্মকর্তা এখানে যোগদান করেন। এর আগে মুন্সিগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর, ঢাকার যাত্রাবাড়ি- এই কর্মকর্তা যখনই যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই গড়ে তুলেছেন দালালদের আলাদা একটি সিন্ডিকেট।
সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাগুরায় দলটির নেতা-কর্মীদের মামলার বিষয়গুলো গোঁপন করে তড়িঘড়ি করে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেন কামাল হোসেন। প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকায় পাসপোর্ট অধিদপ্তরে বিশেষ দূত পাঠিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
পাসপোর্ট করতে আসা এক সেবাপ্রার্থীর অভিযোগ, তিনি বাসা থেকে নিজে নিজে আবেদনপত্র ও পেমেন্টের কাজ করেছেন। কিন্তু যখন কাগজপত্র জমা দিতে এসেছেন, কাউন্টারে ডকুমেন্ট সংকট দেখিয়ে জমা নেয়া হয়নি। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে, তারা বলে দেন সামনের দোকান থেকে যাতে সঠিক নিয়মে আবেদন করি।
নতুন পাসপোর্ট করতে মাগুরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে শ্রীপুর থেকে এসেছেন মাসুদ আলী নামে এক ব্যক্তি। পাসপোর্টের আবেদনপত্র নিজে নিজে পূরণ করে অনলাইনে ফি পরিশোধ করেছেন তিনি। পরবর্তীতে পাসপোর্ট অফিসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কাউন্টারের সামনে যান তিনিসহ এই প্রতিবেদক। সেখানে দায়িত্বে থাকা পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা প্রায় ১৫ মিনিট মোবাইলে কথা বলা শেষ করে বিভিন্ন কাগজপত্র নেই এমন অযুহাতে তার আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যান করে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিন্ডিকেটের বাইরের অধিকাংশ পাসপোর্টের আবেদনই ফিরিয়ে দেয়া হয়।
মাগুরা এলাকার অধিকাংশ বাড়ির কেউ না কেউ বিদেশে আছেন। পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজনদেরকেও বিদেশে নিতে চাচ্ছেন। ঝামেলাবিহীন পাসপোর্ট করতে গিয়ে তারা ওইসব দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মাগুরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা -কর্মচারীরা নিজেদের পকেট ভারি করছেন।
শহরের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা একটা পাসপোর্টের ফরম ফিলাপ, টাকা পেমেন্ট ও সার্ভিস দিয়ে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পাই। অথচ, সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি নিতে হয়।
এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের মার্কা নিতে গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা। অর্থাৎ ৪৮ পৃষ্টার ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য একজন গ্রাহককে সর্বনিম্ন ৬৮০০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকা খরচ করতে হয়। বইয়ের আকার ও মেয়াদে টাকার পরিমাণ বাড়ে। এই টাকা না দিলে পাসপোর্ট অফিসে সেবাপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হন, নানা অজুহাতে আবেদনপত্র ফিরিয়ে দেয়া হয়। আবার, টাকা দিলেই সেবাপ্রার্থীর আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে জমা করা হয়। এটি নতুন কিছু না, মাগুরায় এটি এখন ওপেন সিক্রেট।
পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকে দায়িত্বে থাকা এক আনসার সদস্য (নেমপ্লেট না থাকায় নাম জানা যায়নি ) আড়াই হাজার টাকায় বিষয়টি সুরাহা করতে পারবেন বলে জানান। অনেক দেন দরবার করে শেষে ২ হাজার টাকায় চুক্তিতে রাজি হন তিনি। এরপর কাউন্টারের ভেতরে গিয়ে নিমিষেই সিল মেরে আবেদনকারী ব্যক্তির ফরমের ই-মেইলের স্থানে বিশেষ মার্কা নিয়ে আসেন তিনি। এরপর অন্য একটি রুমে গিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি দিতে বলেন ওই আনসার সদস্য। পরে তার ইশারায় অন্য এক আনসার সদস্য তাকে (আবেদনকারী) সহোযোগিতা করেন।
নির্ভরশীল একটি সূত্র জানায়, আনসার সদস্যরা এই বাড়তি আদায়কৃত অর্থ একা খান না। এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৭০% চলে যায়- উপ পরিচালক কামাল হোসেন সরকারের পকেটে।
সূত্রের দাবি, “উপ- পরিচালক কামাল হোসেন সরকার এই অর্থে ঢাকার যাত্রা বাড়িতে প্লট কিনেছেন, হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত তার ভাইয়ের কাছে টাকা পাঠান প্রতিমাসে। সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নামেও কিনেছেন বিপুল পরিমান সম্পত্তি। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি পুরো সপ্তাহের ভাগের বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদপুরের বাড়িতে নিয়ে যান।” সুচতুর এই কর্মকর্তা ব্যাংকে কোন টাকা রাখেন না বলেও শোনা যায়। যাত্রাবাড়ি, বরিশাল, রংপুর ও মুন্সিগঞ্জের পাসপোর্ট অফিসে থাকা কালীন তার বিরুদ্ধে চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করে দেয়ার অভিযোগ আছে।
অভিযোগের বিভিন্ন বিষয়ে মাগুরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক কামাল হোসেন সরকার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এসকল বিষয় গুলোকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
তিনি আরো বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অনলাইনে যেহেতু পাসপোর্ট এর আবেদন করতে হয় তাই আশেপাশের কম্পিউটারের দোকান থেকে ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হয় আর পাসপোর্ট তো আর মুদি দোকান কিংবা ফটোকপির দোকানে পাওয়া যায় না আবেদন করার পর পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের পাসপোর্ট বুঝিয়ে দেয়া হয় । এখানে সিন্ডিকেটের নামে যে মিথ্যা তথ্য ছাড়ানো হচ্ছে বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল নেই।
বিদেশে অর্থপাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার কোন ভাই বিদেশে থাকে না, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা।
তবে সংবাদ সূত্র নিশ্চিত করেছেন, তার ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন।
উপ-পরিচালক কামাল হোসেন সরকারের দাবি মোতাবেক বিদেশের টাকা পাঠানো এবং তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে পরবর্তী সংবাদে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।
Discussion about this post