নিজস্ব প্রতিবেদক
কবি মোঃ মেহেবুব হক বেড়ে উঠেছেন খুবই সাধারণ পরিবারে। তার বাবা মো. ফজলুল হক ছিলেন একজন রেডিও মেকানিক, আর মা মমতাজ বেগম গৃহিণী। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ছিল নিত্যসঙ্গী, কিন্তু মেহেবুবের পড়াশোনার আগ্রহে কখনো তা ভাটা ফেলতে পারেনি। ক্লাসে সবসময় প্রথম হতেন মেহেবুব। বাড়তি খরচ জোগাতে ক্লাস নাইন থেকে শুরু করেন টিউশনি, পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষকরাও তার বই ও বেতনের খরচ বহন করে সহায়তা করতেন। সেই সাহায্য আর নিজের কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি বুরুজবাগান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। এরপর তিনি চান্স পেয়ে যান স্বপ্নের বুয়েটে।
সংগ্রাম, স্বপ্ন আর আত্মপ্রত্যয়ের মিশেলেই গড়ে ওঠে একজন মানুষের সাফল্যের গল্প। মো. মেহেবুব হকের গল্পটাও তেমনই। যশোর জেলার শার্শা থানার উত্তর বুরুজবাগান গ্রামে ১৯৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জীবনের নানা বাস্তবতা জয় করে তিনি এখন বিসিএস (কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট) ক্যাডারের কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালন করছেন কাস্টমস বিভাগের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে। সরকারি চাকরির পাশাপাশি তিনি নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দিতেও ভালোবাসেন, যিনি ভালোবাসা, মানবতা এবং সুফিবাদ নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় মেহেবুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বুয়েট ছাড়া অন্য কোনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেননি। ২০০৯ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাস্টমস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। প্রশিক্ষণের পর শুরু হয় তার সরকারি চাকরিজীবন। মেহেবুব হকের কবিতার উপজীব্য ভালোবাসা, বিরহ, সুফিবাদ এবং মানবতা। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসার নীলপদ্ম’। এরপর প্রকাশিত হয় ‘নিরন্তর তুমি’, ‘মানবতার দর্পণ’, ‘নীল প্রজাপতি’, ‘নাতের রাসূল (সা.)’, ‘মহামানব’, ‘ঐশী ছোঁয়া’সহ মোট ১৩টি কাব্যগ্রন্থ।
মেহেবুব হককে ‘মানবতার কবি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ তার কবিতায় মানবপ্রেম, নৈতিকতা এবং আত্মজিজ্ঞাসার প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি পেশাগত জীবনে কাস্টমস কর্মকর্তা হলেও, সাহিত্যচর্চায় তার গভীর আগ্রহ ও প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিয়েটিভ আর্টস অ্যাওয়ার্ড ২০২৩, সম্মাননা সনদসহ ফেলোশিপ পান। তিনি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পরিষদ কর্তৃক ভারতের কোলকাতা হতে মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার-২০২৪ সহ সনদ পান। আইসিএএলডিআরসি (ভাষাগত ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ), আইআরসিএসসিডি (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), অমর আশা ফাউন্ডেশন (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) যৌথ আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাবরা হতে মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পান। এছাড়া ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে বেশকিছু পুরস্কারও পেয়েছেন । স্ত্রী নূরজাহান খাতুন রোজী, ছেলে তাহসীন হক ও মেয়ে তাসনোভা জান্নাতকে নিয়ে সুখী পরিবার তার।
মেহেবুব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, কাজেকর্মে সফল মানুষ হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া দরকার। নিজের দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা এবং মানুষের সেবা করাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য।
কবি মোঃ মেহেবুব হকের কবিতার সাহিত্যমূল্য বিচার
কবি মোঃ মেহেবুব হকের কবিতার সাহিত্যমূল্য বিচার করলে দেখা যায়, তাঁর রচনায় প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, মানবতা ও দর্শনের গভীর প্রক্ষেপণ রয়েছে। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যে এক মননশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাঁর কবিতায় আবেগ ও বোধ একসূত্রে মিলে মিশে এক অনন্য ব্যঞ্জনা তৈরি করে।
ভাবমূল্য ও বিষয়বস্তুর গভীরতা
মেহেবুব হকের কবিতায় প্রেম, বিরহ, সমাজ-সংকট, আত্মদর্শন, ঈশ্বরচেতনা, এবং সুফিবাদ উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত। তাঁর কবিতা মানব-মনস্তত্ত্বকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে এবং একটি অন্তর্গত জিজ্ঞাসা পাঠকের মধ্যে জাগিয়ে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘ভালোবাসার নীলপদ্ম’ কাব্যগ্রন্থে তিনি ভালোবাসাকে কেবল রোমান্টিক পরিসরে নয়, আত্মিক পরিসরেও বিশ্লেষণ করেছেন।

ভাষাশৈলী ও কাব্যিক অলংকার
তাঁর কবিতার ভাষা সহজ, সংবেদনশীল এবং আবেগঘন, কিন্তু একই সঙ্গে বিমূর্ত ও ব্যঞ্জনাময়। প্রতীক, রূপক, উপমা, অনুকরণ—alliteration ইত্যাদি অলঙ্কারের দক্ষ ব্যবহার তাঁর কবিতাকে শৈল্পিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ছন্দ ও নির্মাণশৈলী
তিনি মূলত মুক্তছন্দে কবিতা লিখলেও ছন্দের দোলায় কবিতার গতি ও সুর বজায় রাখেন। গদ্যছন্দেও তাঁর কবিতা গীতিময়তা হারায় না। এই দিক থেকে তাঁর কবিতা আধুনিক ও কাব্যিক সমন্বয়ের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
দর্শন ও চিন্তাভাবনার প্রকাশ
তাঁর কবিতায় ইসলামী সুফিবাদ, প্রেম-দর্শন ও দার্শনিক ভাবনার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। যেমন, ঈশ্বরানুসন্ধান, আত্মদর্শন, এবং মানবিক দায়িত্ববোধ – এইসব বিষয়ে তিনি নিঃসঙ্কোচে ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখেন।
সাহিত্যিক অবদান ও প্রভাব
তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন সমকালীন চিন্তাশীল কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর লেখায় একটি শুদ্ধ আত্মিক জগৎ খুঁজে পাওয়া যায়, যা বাংলা কাব্যে বিশেষ মূল্য সংযোজন করেছে।
কবি মোঃ মেহেবুব হকের কবিতা মানসিক ও আত্মিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কবিতা পাঠকের চিন্তার গভীরতা বাড়ায় এবং অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত করে। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর, যাঁর কবিতা যুগ-সচেতন, প্রেমনিবেদিত এবং আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনাপূর্ণ।
Discussion about this post