আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে দীর্ঘদিন পর চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে দুদেশের বৈরীতা। এরই মধ্যে সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত এবং উভয় দেশের মধ্যকার প্রধান স্থল সীমান্ত বন্ধের পাশাপাশি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে ভারতের এসব কর্মকাণ্ডকে ‘শিশুসুলভ’ আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জবাব দিতে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) জরুরি বৈঠক ডেকেছে পাকিস্তান।
এমন পরিস্থিতি চির শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের মধ্যে আরও একবার যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে একদিকে বড় দুই যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যস্ত বিশ্ব, অন্যদিকে চরম বাণিজ্যযুদ্ধের মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র-চীন ও অবশিষ্ট বিশ্ব, সেখানে ভারত-পাকিস্তান সশস্ত্র যুদ্ধের বাস্তবতা কতটুকু, তা নিয়ে রয়ে গেছে প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দক্ষিণ কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পাহালগামে ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলা ঘটে গেছে, যেখানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৬ পর্যটক। এছাড়া, আহত হয়েছেন আরও ১৭ জন। নিহতদের মধ্যে একজন সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং একজন নেপালের নাগরিক ছিলেন। এছাড়া দুইজন স্থানীয় বাসিন্দাও রয়েছেন।
ঘটনার খবর পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে সৌদি সফর সংক্ষিপ্ত করে ভারতে ফেরেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বুধবার (২৩ এপ্রিল) ভোরে বিমানবন্দরে পা রেখেই ঘোষণা দেন, কাশ্মীরে বন্দুক হামলায় জড়িত কোনো ব্যক্তিকে রেহাই দেওয়া হবে না।
ওইদিনই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন মোদি।
নিরাপত্তা কমিটির ওই বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত হলো সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করা। পাকিস্তানের বহু এলাকার কৃষিকাজ এবং পানীয় জলের উৎস হচ্ছে সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলো—বিশেষ করে ঝিলম, চেনাব, রবি, বিয়াস ও সাতলুজ। পাকিস্তানের জন্য বড় এক ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে এ সিদ্ধান্তকে। এছাড়া, দুদেশের মধ্যকার প্রধান স্থল সীমান্ত আটারি-ওয়াঘা চেকপোস্টও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও এসেছে। যারা সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছেন, তাদের ১ মে’র মধ্যে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে ভারত।
পাশাপাশি সব ধরনের ‘সার্ক’ ভিসা বাতিল করে ভারতে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদেরও এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছে। এছাড়া, ভারতের ইসলামাবাদ দূতাবাসে কর্মরত কর্মকর্তাদের সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা কমিটির ওই বৈঠকে।
এদিকে ভারতের এসব পদক্ষেপকে ‘শিশুসুলভ’ বলে অভিহিত করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। একইসঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জবাব দিতে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) জরুরি বৈঠকও ডাকা হয়েছে।
ইসহাক দার জানান, এ বৈঠকে সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন এবং সাধারণত কেবলমাত্র বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা বা বহিরাগত হুমকির সময় এই ধরনের বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে বৃহস্পতিবার।
তিনি বলেন, ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম হবে না।
এছাড়া কাশ্মীরের সাম্প্রতিক হামলাকে ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ (false flag)’ অপারেশন বলে আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তান। অর্থাৎ তারা দাবি করছে, ভারত নিজেরাই এই হামলা সাজিয়েছে যেন পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপানো যায়। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ‘কখনোই পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না ফলস ফ্ল্যাগের এই সম্ভাবনাকে।’
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রেডিও পাকিস্তান বলছে, ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে।
এ অবস্থায় দীর্ঘদিন পর আবারও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকে। অবশ্য, যেখানে এই মূহুর্তে বড় দুই যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যস্ত বিশ্ব মোড়লেরা, সেখানে নতুন আরেকটি যুদ্ধে দুই দেশ তাদের মিত্রদের কাছ থেকে কতটা সমর্থন পাবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে প্রশ্ন। এছাড়া, ভারত-পাকিস্তান নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে স্বাভাবিকভাবে ফায়দা খোঁজার চেষ্টা করবে চীন। সে দিক বিবেচনায়, যুদ্ধের মতো চরম পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে চাইবে কি না ভারত, সেটাও ভাবনার বিষয়। অন্যদিকে তৃতীয় কোনও পক্ষ বিশেষ করে মার্কিন কিংবা চীনা সমর্থন ছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে চলতে থাকা পাকিস্তানও সশ্রস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।
এছাড়া, বিশ্ব অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে বিরাজমান অর্থনৈতিক অনিশ্চিয়তা ও সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে আরেকটি বড় যুদ্ধ সৃষ্টি করতে পারে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি।
Discussion about this post